-->

দিনেশ দাসের ‘কাস্তে’ কবিতার মূল ভাববস্তু // প্রতীকধর্মী কবিতা হিসেবে দিনেশ দাসের ‘কাস্তে’

 

দিনেশ দাসের ‘কাস্তে’ কবিতার মূল ভাববস্তু // প্রতীকধর্মী কবিতা হিসেবে দিনেশ দাসের ‘কাস্তে’


প্রতীকধর্মী কবিতা হিসেবে দিনেশ দাসের ‘কাস্তে’

অতি প্রাচীনকাল থেকেই সাহিত্যে শিল্পকলায় ভাস্কর্যে প্রায় সর্বত্রই প্রতীক ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রতীক মাত্রেই কোনো কিছুর পরিবর্তে বসে। কিন্তু প্রতীক যাকে সঙ্কেত করে তাকে তার সঙ্গে এক করে ফেলা যায় না। কারণ—Symbols are not proxy for their object, but are vehicles for the conception of object, and it is the conceptions, not the things, that symbols directly ‘mean’অর্থাৎ প্রতীক নিজেকে অতিক্রম করে অন্য কিছুর সংকেত করে।

দিনেশ দাসের কাস্তেকবিতাটিকে অবশ্য প্রতীকধর্মী বলা যেতে পারে। কাস্তেএই প্রতীকটির মধ্যে দিয়ে তিনি ব্যাপকতর ও গভীরতর ব্যঞ্জনা প্রকাশ করেছেন। কাস্তেকৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের হাতিয়ার, কাস্তে ধারালো অস্ত্র হলেও তার শক্তি ও কার্যকারিতা সামান্যই। কাস্তে দিয়েই কৃষক ধান কাটে। এই অস্ত্রটি ছাড়া ক্ষুধার অন্ন জোটে না। কৃষিনির্ভর এই বঙ্গ দেশে কৃষি সভ্যতার প্রতীক এই কাস্তে। অবশ্য বিপদের দিনে আত্মরক্ষাতেও সাহায্য করে এই অস্ত্রটি।

কাস্তেকবিতায় কবি কাস্তেকে অনেক ব্যাপক ও বৃহত্তর শক্তির প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করেছেন। পৃথিবীময় চলেছে মারণ অস্ত্র আবিষ্কার ও ব্যবহারের প্রতিযোগিতা। আছে বেয়নেট বোমা কামান বন্দুক। এই অস্ত্রের শক্তিতেই এক জাতি অন্য জাতিকে পদানত করতে চায় । তাই বার বার যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয় পৃথিবী। কিন্তু কবি বিশ্বাস করেন কেবল উন্নতমানের অস্ত্র দিয়েই পৃথিবীর অগণিত মানুষকে পদানত করে রাখা যাবে না। মানুষের মধ্যে আছে প্রতিরোধ প্রতিবাদের শক্তি। সংঘশক্তি মানুষের মনে এনে দেয় দুর্জয় সাহস। কাস্তে এখানে সেই প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের প্রতীক। কবিতার শুরুতেই তাই কবি বলেছেন—“বেয়নেট হোক যত ধারালোকাস্তেটা ধার দিও বন্ধু।

বেয়নেট, বোমা ইত্যাদির তুলনায় কাস্তের শক্তি সামান্য হলেও তার মধ্যেই আছে অমিত সম্ভাবনা। কাস্তের মধ্যেই আছে সৃষ্টির এবং আত্মরক্ষার শক্তি। অন্যদিকে বেয়নেটধারীরা কেবল ধ্বংসই করতে পারে। কাস্তের শক্তি সামান্য হলেও কাস্তের মধ্যে আছে অভাবিতপূর্ব শক্তির উৎস।

একফালি চাঁদ দেখে কবির মনে পড়ে যায় সেই কাস্তের কথা। চাঁদ আজ আর কবির কাছে রোমান্টিকতার বিষয় নয়। চাঁদকে নিয়ে অনেক কবি অনেক রোমান্টিক কাব্য লিখেছেন। কিন্তু কবির কাছে চাঁদ ঝলসানো রুটি। তাই কবি সাবধান করে দিয়ে বলেন,–“চাঁদের শতক আজ নহে তো, এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে।

যে চাঁদ এতদিন রোমান্টিকতার প্রতীক ছিল, সেই চাঁদ আজ নবযুগের প্রতীক হয়ে দেখা দিয়েছে।

কবি বিশ্বাস করেন পাপ অন্যায় তার নিজের দুর্বলতাতেই ভেঙে পড়বে। আত্মঘাতী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে একদিন তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। পৃথিবীর ইতিহাসে বার বার এ সত্যটি প্রমাণিত হয়েছে। নিষ্ঠুর রক্তপাতে মাটি হয়েছে রক্তাক্ত। আবার সেই মাটিতেই জন্ম নেবে নতুন পৃথিবী।

লৌহের পৃথিবীশব্দটিও প্রতীকধর্মী। শ্যামলতা মাধুর্য মুছে ফেলে আজ পৃথিবীটা লোহার শৃঙ্খলে বাঁধা পড়েছে। কিন্তু এই সব শক্তিধরেরা ভুলে গিয়েছে এটা মাটির যুগ। লৌহের পৃথিবীশক্তিমত্ত ফ্যাসিস্টদের সর্বগ্রাসী আধিপত্যের প্রতীক। কিন্তু রক্তসমুদ্রএক নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করে। মানুষের রক্তে ভিজে যাওয়া মাটিতেই আবার জন্ম দেয় নবজীবনের প্রতিশ্রুতি। তাই কবি এই যুগটিকে বলেছেন মাটির যুগ। মাটি আর মানুষ এই দুই-এর মেল- বন্ধনে জন্ম নেবে পৃথিবী। একদিন চূর্ণ হয়ে যাবে এই লৌহের পৃথিবী। আশাবাদী কবির চোখে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন।

সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই ফিরে পেতে হবে মাটির অধিকার। তাই আজ কাস্তেটাকে শাণিত রাখা প্রয়োজন। কাস্তে যেমন সংগ্রামের প্রতীক, তেমনি মাটির প্রতীক। কবি তাই বলেন— ‘কাস্তেটা রেখেছ কি শানায়ে/এ-মাটির কাস্তেটা বন্ধু।

পৃথিবীটা দিনে দিনেই যান্ত্রিক হয়ে উঠছে। বিজ্ঞানদর্শী সভ্যতা গ্রাস করছে মাটির শ্যামলিমাকে। তাই আজ প্রতিরোধ। কাস্তে আর নিরীহ ফসল কাটার অস্ত্রমাত্র নয় । এক ফালি চাঁদের বিলাসিতা আর নয়। কাস্তে প্রতিরোধের প্রতীক। আর আত্মরক্ষার হাতিয়ার এই কাস্তে কাস্তে কবিতায় তাই এই অস্ত্রটি শ্রমজীবী মানুষের প্রতীক। পৃথিবীকে অনিবার্য ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে আজ এই কাস্তে হাতেই যুদ্ধে নামুক জনশক্তি। সেই আহ্বানই ধ্বনিত হয়েছে প্রতীকধর্মী কবিতাটিতে।



বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরো নোট পেতে সাহিত্য বাংলা WhatsApp Group-এ যুক্ত হন